স্বামী বিবেকানন্দ উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী। তিনি শুধু একজন আধ্যাত্মিক নেতা নন, বরং একজন দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ, এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন। তাঁর জীবন ও দর্শন আজও সারা পৃথিবীতে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
সূচীপত্র:
স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী:
বিষয় | তথ্য |
---|---|
আসল নাম | নরেন্দ্রনাথ দত্ত |
জন্ম | ১২ জানুয়ারি, ১৮৬৩ |
জন্মস্থান | ৩ নং গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট, কলকাতা |
পিতা | বিশ্বনাথ দত্ত |
মাতা | ভুবনেশ্বরী দেবী |
মৃত্যু | ৪ জুলাই, ১৯০২ |
শৈশব ও পরিবার:
স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি শিমলা পাড়ায় (বর্তমানে ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট) এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে। তাঁর পিতার নাম বিশ্বনাথ দত্ত, যিনি ছিলেন একজন দক্ষ আইনজীবী এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষ। তাঁর মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন ধর্মপরায়ণ এবং ভক্তিমতী। তাঁর যাঁর জন্ম নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। শৈশব থেকেই নরেন্দ্রনাথ ছিলেন মেধাবী, জিজ্ঞাসু এবং ধ্যান পরায়ণ। তিনি ছোটবেলা থেকেই যোগ-সাধনায় আগ্রহী ছিলেন এবং প্রায়ই ধ্যানে মগ্ন থাকতেন।
শিক্ষাজীবন:
নরেন্দ্রনাথ প্রথমে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) এবং পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন। তিনি দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, সংস্কৃত সাহিত্য এবং পাশ্চাত্য দর্শনে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। হার্বার্ট স্পেনসার, জন স্টুয়ার্ট মিল, অগস্ত কোঁত, চার্লস ডারউইন প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের রচনা তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন।
বিষয় | তথ্য |
---|---|
স্কুল | মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন |
কলেজ | প্রেসিডেন্সি কলেজ |
পড়াশোনার বিষয় | দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম |
আধ্যাত্মিক দীক্ষা:
১৮৮১ সালে নরেন্দ্রনাথের জীবনে বড় পরিবর্তন আসে, যখন তিনি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রথম সাক্ষাতেই তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন। কিন্তু সংশয়বাদী নরেন্দ্রনাথ প্রথমে শ্রীরামকৃষ্ণের অলৌকিক অনুভূতি ও ঈশ্বর দর্শনের কথা বিশ্বাস করতে পারেননি। তিনি বারবার প্রশ্ন করে শ্রীরামকৃষ্ণকে পরীক্ষা করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ধৈর্য ধরে তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবং ক্রমে নরেন্দ্রনাথের সংশয় দূর হয়েছে। তিনি নরেন্দ্রনাথ থেকে হয়ে ওঠেন স্বামী বিবেকানন্দ।
শ্রীরামকৃষ্ণের অসুস্থতার সময় স্বামীজি অন্যান্য যুবক শিষ্যদের সঙ্গে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে গুরুর সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। ১৮৮৬ সালের ১৬ আগস্ট শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধির পর তিনি সহ-শিষ্যদের নিয়ে বরাহনগরে একটি মঠ স্থাপন করেন। এখানেই তিনি ও তাঁর সহ-শিষ্যরা সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।
পরিব্রাজক জীবন:
১৮৮৮ সালে স্বামী বিবেকানন্দ ভারতবর্ষ ভ্রমণে বের হন। তিনি পায়ে হেঁটে ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান ভ্রমণ করেন। এই সময় তিনি ভারতের দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও কুসংস্কার প্রত্যক্ষ করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে ভারতের জনগণের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত করার পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নও প্রয়োজন।
শিকাগো ধর্ম মহাসভা:
১৮৯৩ সালে শিকাগোতে বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় যোগদানের জন্য স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকা যান। ১১ সেপ্টেম্বর তিনি মহাসভায় “Sisters and brothers of America! – আমেরিকার ভগিনী ও ভাতৃগণ!” সম্বোধন দিয়ে যে ভাষণ দেন, তা বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগায়। তিনি হিন্দু ধর্মের সর্বজনীনতা ও সহিষ্ণুতার বার্তা প্রচার করেন। তাঁর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে অনেক পাশ্চাত্য মনীষী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
পাশ্চাত্য দেশে বেদান্ত প্রচার:
শিকাগো ধর্ম মহাসভার পর স্বামীজি আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বেদান্ত দর্শন প্রচার করেন। তিনি নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস প্রভৃতি শহরে বক্তৃতা দেন এবং বেদান্ত সোসাইটি স্থাপন করেন। তাঁর বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে পাশ্চাত্য জগৎ ভারতীয় দর্শন ও যোগবিদ্যার গভীরতা সম্পর্কে অবগত হয়।
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতিষ্ঠা:
১৮৯৭ সালে স্বামীজি ভারতে ফিরে আসেন এবং বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। এই বছরই তিনি রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানবসেবার মাধ্যমে ঈশ্বর সেবা। রামকৃষ্ণ মিশন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ত্রাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে।
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।
স্বামী বিবেকানন্দ
মঠ ও মিশনের কার্যক্রম:
- শিক্ষা ও চিকিৎসা পরিষেবা।
- দুর্যোগকালে ত্রাণ কার্যক্রম।
- আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষা।
প্রতিষ্ঠানের নাম | কাজের ধরন |
---|---|
রামকৃষ্ণ মঠ | আধ্যাত্মিক শিক্ষা |
রামকৃষ্ণ মিশন | সামাজিক সেবা |
জাতীয়তাবাদী ও দার্শনিক চিন্তাধারা:
স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন ছিল অদ্বৈতবাদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা। তিনি মনে করতেন প্রত্যেক জীবাত্মাই ব্রহ্মস্বরূপ। তাঁর মতে, ধর্মের লক্ষ্য হল আত্মজ্ঞান লাভ করা। তিনি কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও রাজযোগের সমন্বয় সাধন করেন।
স্বামীজির শিক্ষাভাবনা ছিল অত্যন্ত প্রগতিশীল। তিনি মনে করতেন শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের অন্তর্নিহিত পূর্ণতা প্রকাশ করতে হবে। তিনি স্ত্রী শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর মতে, নারী শিক্ষার প্রসার ছাড়া দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। তিনি বৈজ্ঞানিক শিক্ষার সঙ্গে আধ্যাত্মিক শিক্ষার সমন্বয়ের কথা বলেন।
স্বামীজি ছিলেন একজন প্রকৃত জাতীয়তাবাদী। তিনি ভারতের যুব সমাজকে দেশসেবায় উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি বলতেন, “ভারত জাগলে জগৎ জাগবে।” তিনি ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন।
আরও পড়ুন: ভগিনী নিবেদিতার জীবনী: এক বিদেশিনীর ভারত প্রেম
সামাজিক চিন্তাধারা:
স্বামী বিবেকানন্দের সামাজিক চিন্তাভাবনা ছিল অত্যন্ত প্রগতিশীল ও যুগোপযোগী। তিনি উনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় সমাজের নানাবিধ সমস্যা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এবং তার সমাধানের পথ দেখিয়ে ছিলেন। তাঁর প্রধান চিন্তাধারা:
- জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা: জাতিভেদকে সমাজের অভিশাপ বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর বিরাজমান, তাই সকলেই সমান।
- দারিদ্র্য দূরীকরণ: দারিদ্র্য দূর করতে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ওপর জোর দেন। তিনি বলতেন, “ক্ষুধার্তকে আগে খাবার দাও, পরে ধর্ম শেখাও।”
- নারী শিক্ষা ও মুক্তি: নারী শিক্ষাকে জাতির উন্নতির মূল ভিত্তি বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, নারীদের শিক্ষাই পরিবার ও সমাজকে সমৃদ্ধ করবে।
- অস্পৃশ্যতা বিরোধিতা: অস্পৃশ্যতাকে ধর্ম ও মানবতার বিরোধী বলে অভিহিত করেন। তিনি তাদের উন্নয়নের জন্য কাজ করতেন এবং সমানভাবে সম্মান দিতেন।
- ধর্মীয় সহিষ্ণুতা: শ্রীরামকৃষ্ণের বলা “যত মত তত পথ” নীতিতে বিশ্বাস করে সকল ধর্মকে সম্মান করতেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করতেন।
- শিক্ষার মাধ্যমে পরিবর্তন: শিক্ষা শুধু জীবিকা নয়, জীবনের জন্য হওয়া উচিত বলে মত দিতেন। শিক্ষার মাধ্যমে চরিত্রগঠন ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে জোর দিতেন।
- যুব সমাজের প্রতি আহ্বান: যুব সমাজকে পরিবর্তনের বাহক হিসেবে দেখতেন। তাঁর আহ্বান ছিল, “উঠো, জাগো, লক্ষ্যে পৌঁছানো পর্যন্ত থেমো না।”
- সমাজসেবা ও মানবতাবাদ: “শিবজ্ঞানে জীবসেবা” নীতিতে সমাজসেবাকে ধর্মের অঙ্গ হিসেবে দেখতেন। তিনি তাত্ত্বিকের চেয়ে বাস্তব কর্মে বিশ্বাস করতেন।
সাহিত্য ও রচনাবলী:
স্বামীজি একজন প্রতিভাবান লেখক ছিলেন। তাঁর রচনাবলী বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই সমান জনপ্রিয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে ‘রাজযোগ’, ‘জ্ঞানযোগ’, ‘কর্মযোগ’, ‘ভক্তিযোগ’, ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’, ‘বর্তমান ভারত’ ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি অসংখ্য পত্র লিখেছেন, যা ‘পত্রাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বাণী ও রচনা আজও লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
শিষ্য ও শিষ্যা মন্ডলী:
আইরিশ মহিলা মার্গারেট নোবেল (পরবর্তীতে ভগিনী নিবেদিতা) স্বামীজির অন্যতম প্রধান শিষ্যা ছিলেন। তিনি ১৮৯৫ সালে লন্ডনে স্বামীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং পরে ভারতে এসে নারী শিক্ষা ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। স্বামীজি তাঁকে ‘নিবেদিতা’ নাম দেন। নিবেদিতা ভারতীয় শিল্প, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
স্বামীজির অনেক বিখ্যাত শিষ্য ছিলেন, যাঁরা পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মিশনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। এঁদের মধ্যে স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী শিবানন্দ, স্বামী সারদানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। পাশ্চাত্য দেশে তাঁর প্রভাবশালী শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন জে.জে. গুডউইন, সারা এলেন ওয়াল্ডো, জোসেফাইন ম্যাকলাউড প্রমুখ।
দ্বিতীয় বিদেশ ভ্রমণ:
১৮৯৯ সালে স্বামী বিবেকানন্দ দ্বিতীয়বার পাশ্চাত্য দেশ ভ্রমণে যান। এবার তিনি আমেরিকা ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। তিনি প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে যোগদান করেন। এই সময় তিনি মিশর, গ্রীস, তুরস্ক প্রভৃতি দেশও ভ্রমণ করেন।
শেষজীবন ও মহাসমাধি:
স্বামীজির স্বাস্থ্য ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছিল। তিনি মধুমেহ, অস্থমা প্রভৃতি রোগে ভুগছিলেন। তবুও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন। ১৯০২ সালের ৪ জুলাই সন্ধ্যায় তিনি বেলুড় মঠে ধ্যানে বসেন এবং মহাসমাধিতে লীন হন। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
শেষ কথা:
স্বামী বিবেকানন্দের জীবন ছিল কর্ম এবং চিন্তার অনন্য মেলবন্ধন। তাঁর দর্শন, শিক্ষা, এবং কর্মযজ্ঞ শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। তিনি প্রমাণ করে গেছেন, আধ্যাত্মিকতা এবং সমাজসেবা একে অপরের পরিপূরক। তাঁর জীবন আজও কোটি কোটি মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা।
Source: Wikipedia