অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের (হিন্দু ধর্মের একটি শাখা সম্প্রদায়, যারা মূলত বিষ্ণু ও তাঁর বিভিন্ন অবতারকে পূজা করে থাকেন) একজন বিশিষ্ট আচার্য এবং ইসকন (আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ)-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি “ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ”, “ভক্তিবেদান্ত শ্রীল প্রভুপাদ” “স্বামী প্রভুপাদ”, “শ্রীল প্রভুপাদ” নামেও পরিচিত। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের গৌড়ীয় মতবাদকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য। তার প্রতিষ্ঠিত ইসকন মন্দিরগুলি সারা বিশ্বে ভক্তির প্রসার ঘটায় এবং অসংখ্য মানুষকে কৃষ্ণভাবনামৃত জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে।
সূচীপত্র:
অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের জীবনী:
বিষয় | তথ্য |
---|---|
সম্পূর্ণ নাম | অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ |
জন্ম নাম | অভয়চরণ দে |
জন্ম | ১ সেপ্টেম্বর ১৮৯৬ |
জন্মস্থান | কলকাতা, ভারত |
পিতা | গৌর মোহন দে |
মাতা | রজনী দেবী |
পরিবার | বিবাহিত এবং সন্তান ছিল |
শিক্ষা | স্কটিশ চার্চ কলেজ, কলকাতা (ইংরেজি ও সংস্কৃত অধ্যয়ন) |
পেশা (বিবাহিত জীবনে) | ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসার মালিক |
সন্ন্যাস গ্রহণের তারিখ | ১৯৫৯ সাল |
মৃত্যু | ১৪ নভেম্বর ১৯৭৭, বৃন্দাবন, ভারত |
শৈশব ও পারিবারিক জীবন:
১৮৯৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর স্বামী প্রভুপাদের জন্ম হয় কলকাতার একটি সম্ভ্রান্ত সুবর্ণবণিক পরিবারে। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয় অভয়চরণ দে। খুব আশ্চর্যের বিষয় যে, তিনি জন্মাষ্টমীর দিনে জন্মগ্রহণ করেন। এই দিনটি হিন্দু ধর্মের বৈষ্ণব মতে খুবই পবিত্র দিন।
তার বাবার নাম ছিল গৌর মোহন দে আর মায়ের নাম ছিল রজনী দে। দুজনেই ছিলেন খুব ধার্মিক এবং কৃষ্ণভক্ত। সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী, তার মা প্রসবের জন্য বাপের বাড়িতে গিয়েছিলেন। জন্মের কিছুদিন পর অভয়চরণকে নিয়ে তারা ফিরে আসেন কলকাতার হ্যারিসন রোডে, যেখানে তাদের বাড়ি ছিল। এই বাড়িতেই তিনি বড় হন। ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব মেধাবী ছিলেন।
শিক্ষাজীবন:
অভয়চরণ পড়াশোনা করেছিলেন কলকাতার বিখ্যাত স্কটিশ চার্চ কলেজে। এই কলেজটি ছিল তাদের বাড়ির কাছেই, উত্তর কলকাতায়। সেখানে অনেক ভালো পরিবারের ছেলেরা পড়ত। তিনি কলেজে ইংরেজি ছাড়াও সংস্কৃত ভাষা নিয়েও পড়াশোনা করেন। এই দুই ভাষায় তার দক্ষতা পরে তার জীবনে খুব কাজে এসেছিল। বিশেষ করে যখন তিনি বিদেশে গিয়ে ধর্ম প্রচার করেন।
পারিবারিক জীবন:
অভয়চরণের বিয়ে হয়েছিল এবং তার সন্তানও ছিল। তিনি একটি ছোট ওষুধের ব্যবসা করতেন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনি এই ব্যবসা চালিয়েছেন। এরপর তিনি সংসার থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকেন।
আধ্যাত্মিক জীবনের শুরু:
১৯৫৯ সালে তিনি সন্ন্যাস নেন। এর পর থেকে তিনি পুরোপুরি ধর্মীয় জীবন যাপন শুরু করেন। তিনি বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থগুলি নিয়ে গভীর অধ্যয়ন করতে থাকেন এবং সেগুলির ব্যাখ্যা লেখেন।
আমেরিকা যাত্রা এবং ইসকন প্রতিষ্ঠা:
১৯৬৫ সালে, প্রায় ৭০ বছর বয়সে, স্বামী প্রভুপাদ একটি জাহাজে করে আমেরিকা যান। তার স্বপ্ন ছিল পশ্চিমের দেশগুলিতে কৃষ্ণভক্তি ছড়িয়ে দেওয়া। ১৯৬৬ সালে তিনি ইসকন প্রতিষ্ঠা করেন। এটি আজ ‘হরে কৃষ্ণ আন্দোলন‘ নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। প্রথম দিকে মাত্র কয়েকজন শিষ্য নিয়ে শুরু করেন।
১৯৬৭ সালের ৯ই জুলাই তিনি আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকো শহরে প্রথম রথযাত্রার আয়োজন করেন। এটি ছিল পাশ্চাত্যে প্রথম রথযাত্রা। শহরের রাস্তায় এই উৎসব দেখে অনেক মানুষ আকৃষ্ট হন।
বিশ্বব্যাপী প্রভাব:
স্বামী প্রভুপাদ আমেরিকা, ইউরোপ, ভারত সহ বিশ্বের অনেক দেশে ভ্রমণ করেন। তার সরল শিক্ষা এবং ভক্তিমূলক বাণী শুনে হাজার হাজার মানুষ তার শিষ্য হন। ধীরে ধীরে তার শিক্ষা আমেরিকার যুবসমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার আমেরিকান যুবক-যুবতী তার কাছে দীক্ষা নেন।
মন্দির প্রতিষ্ঠা:
১৯৭৭ সালে তিনি বিশ্বজুড়ে ১০৮টি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে ভারতের বৃন্দাবনে কৃষ্ণ-বলরাম মন্দির অন্যতম। এই মন্দিরগুলি আজও কৃষ্ণভক্তি প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে।
আরও পড়ুন: শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জীবনী: এক আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক
তার রচনাসমূহ:
ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ তার জীবনের বড় অংশ বই রচনায় ব্যয় করেন। তার গুরু ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী তাকে বলেছিলেন, “যদি কখনো টাকা পাও, বই ছাপাও।” সেই অনুপ্রেরণায় প্রভুপাদ দিনে শিষ্যদের পরিচালনা ও আন্তর্জাতিক ইসকন-এর কাজ দেখাশোনা করতেন এবং রাতে মূলত তার বই লেখার কাজ চালাতেন।
- ভগবদ্গীতা আস ইট ইজ (Bhagavad-gita As It Is):
১৯৬৮ সালে প্রথম প্রকাশিত এই বই ভগবদ্গীতার একটি অখণ্ড ও ঐতিহ্যবাহী ব্যাখ্যা প্রদান করে। এটি ৫০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত কোটি কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। - শ্রীমদ্ভাগবতম (Srimad-Bhagavatam):
শ্রীমদ্ভাগবতম একটি গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র গ্রন্থ যা প্রভুপাদ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করেন। তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত এর উপর কাজ চালিয়ে যান এবং ৯টি ক্যান্টো সম্পূর্ণ করেন। - চৈতন্য চরিতামৃত (Caitanya-caritamrita):
শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবন ও শিক্ষার উপর ভিত্তি করে এই রচনা প্রভুপাদ ১৯৭৪ সালে সম্পূর্ণ করেন। এটি ১৭টি খণ্ডে প্রকাশিত হয় এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উপর বিশদ তথ্য প্রদান করে। - নেকটার অফ ডিভোশন (The Nectar of Devotion):
ভক্তিরসামৃতসিন্ধু-এর সারসংক্ষেপ, যা ভক্তির বিভিন্ন স্তর ও অনুশীলন নিয়ে লেখা। - ঈশোপনিষদ (Ishopanishad):
১৯৬৯ সালে প্রভুপাদ এই উপনিষদের ১৮টি মন্ত্র অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করেন। এটি বৈদিক ধর্মতত্ত্বের মূল বিষয় তুলে ধরে। - কৃষ্ণ, দ্য সুপ্রিম পার্সোনালিটি অফ গডহেড (Krsna, the Supreme Personality of Godhead):
শ্রীমদ্ভাগবতমের দশম ক্যান্টোর সারসংক্ষেপ, যা শ্রীকৃষ্ণের জীবন ও লীলার উপর আলোকপাত করে।
স্বামী প্রভুপাদ তার রচনার মাধ্যমে গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার লেখা বইগুলো এখনও লক্ষ লক্ষ মানুষকে আধ্যাত্মিকতার পথে অনুপ্রাণিত করছে।
বিশেষ স্বীকৃতি:
অনেক ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ স্বামী প্রভুপাদের কাজের প্রশংসা করেছেন। জে. স্টিলসন জুডা, হারভে কক্স, ল্যারি শিন এবং টমাস হপকিন্স প্রমুখ পণ্ডিতরা তার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেন। তারা তার লেখা বইগুলির খুব প্রশংসা করেন। শুধু পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরাই নয়, ভারতের অন্যান্য বৈষ্ণব সম্প্রদায়ও তার কাজের স্বীকৃতি দেন। তারা তাকে একজন মহান আচার্য হিসেবে সম্মান করেন।
বিশেষ অবদান:
প্রভুপাদ শুধু ধর্মপ্রচারক ছিলেন না। তিনি একজন ভালো লেখকও ছিলেন। তিনি অনেক বই লিখেছেন এবং সংস্কৃত গ্রন্থগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। পাশ্চাত্যে তিনি একটি নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্ম দেন। সেখানকার যুবসমাজ তার দেখানো পথে জীবন যাপন করতে শুরু করে। তারা মাদক ও অন্যান্য খারাপ অভ্যাস ছেড়ে সাত্ত্বিক জীবন যাপন শুরু করে।
শেষ জীবন:
১৯৭৭ সালের ১৪ই নভেম্বর, ৮১ বছর বয়সে স্বামী প্রভুপাদ মহাপ্রয়াণ করেন। দীর্ঘদিনের অসুস্থতার পর তিনি বৃন্দাবনের কৃষ্ণ-বলরাম মন্দিরের তাঁর নিজের কক্ষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই মন্দিরটি তিনি নিজে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তাঁর শেষ সময়টা কেটেছিল সেই মন্দিরেই, যেখানে তিনি জীবনের শেষদিকে বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। তাঁর অনেক শিষ্য সেই সময় তাঁর পাশে ছিলেন। বর্তমানে তাঁর সমাধি রয়েছে সেই কৃষ্ণ-বলরাম মন্দিরের প্রাঙ্গণে। তাঁর শিষ্যরা একটি সুন্দর সমাধি মন্দির নির্মাণ করেছেন সেখানে। আজও প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত এই সমাধি মন্দির দর্শন করতে আসেন।
এই সমাধি মন্দির বৈষ্ণব ঐতিহ্য অনুযায়ী নির্মিত হয়েছে। প্রতিদিন সকালে এখানে পুজা হয়, ফুল চন্দন দেওয়া হয়, এবং ভক্তরা প্রদক্ষিণ করেন। এটি শুধু একটি স্মৃতিসৌধই নয়, একটি পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবেও বিবেচিত হয়। বৃন্দাবনের এই স্থানটি এখন ইসকনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। দুনিয়ার সব প্রান্ত থেকে ভক্তরা এখানে আসেন স্বামী প্রভুপাদের স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানাতে। তাঁর সমাধি মন্দির আজও তাঁর শিক্ষা এবং আদর্শের একটি জীবন্ত প্রতীক হয়ে রয়েছে।
তার আদর্শ ও প্রভাব:
প্রভুপাদের সবচেয়ে বড় অবদান হল তিনি প্রাচীন ভারতীয় বৈষ্ণব মতাদর্শকে আধুনিক বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন। তিনি দেখিয়ে দেন যে প্রাচীন জ্ঞান আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক। বড় বড় পণ্ডিতরা তার কাজের প্রশংসা করেছেন। তার লেখা বইগুলি আজও পড়ানো হয় বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
প্রভুপাদ বলতেন, ধর্ম মানে শুধু পূজা-অর্চনা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবনযাপনের পদ্ধতি। তিনি সরল জীবন ও উচ্চ চিন্তার কথা বলতেন। তিনি শিখিয়েছেন যে ভগবানের নাম জপ করলে মন শান্ত হয়। তাই তিনি ‘হরে কৃষ্ণ’ মন্ত্র জপের উপর জোর দিতেন।
আজ বিশ্বজুড়ে ইসকনের শত শত মন্দির আছে। লাখ লাখ ভক্ত প্রভুপাদের দেখানো পথে চলছেন। তার লেখা বইগুলি কোটি কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। তার জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি যে বয়স কখনো বাধা হতে পারে না। ৭০ বছর বয়সেও তিনি নতুন করে শুরু করেছিলেন।
শেষ কথা:
স্বামী প্রভুপাদের জীবন ছিল একটি মহৎ উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। তিনি দেখিয়ে গেছেন কীভাবে একজন সাধারণ মানুষ আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলতে পারে। তার জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি দৃঢ়তা, সাহস এবং ভক্তির মাহাত্ম্য। তার প্রতিষ্ঠিত ইসকন আজও বিশ্বের মানুষকে শান্তি এবং আধ্যাত্মিক জীবনের পথ দেখিয়ে চলেছে।
Source: Wikipedia