সারদা দেবী ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে, গ্রামের সাধারণ মেয়ে। কিন্তু তাঁর জীবনের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা, আর মানুষের প্রতি সেবা তাঁকে করেছে হাজার হাজার মানুষের মা। শ্রীরামকৃষ্ণের স্ত্রী হলেও তিনি নিজ গুণে পরিচিত হয়েছিলেন “শ্রী শ্রী মা” নামে।
সূচীপত্র:
শ্রী শ্রী মা সারদা দেবীর জীবনী:
বিষয় | তথ্য |
---|---|
আসল নাম | সারদামণি মুখোপাধ্যায় |
জন্ম | ২২ ডিসেম্বর, ১৮৫৩ |
জন্মস্থান | বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রাম |
পিতা | রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় |
মাতা | শ্যামাসুন্দরী দেবী |
স্বামী | শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব (গদাধর চট্টোপাধ্যায়) |
মৃত্যু | ২০ জুলাই, ১৯২০ |
শৈশব ও পরিবার:
১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামের এক গরিব কৃষক পরিবারে সারদার জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ছিল রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় । তিনি চাষবাস করতেন আর পুজোর কাজ করে যা উপার্জন করতেন, তা দিয়েই সংসার চলত। তাঁর মা শ্যামাসুন্দরী দেবী খুব পরিশ্রমী এবং ধার্মিক মহিলা ছিলেন। সারদা ছিলেন তাঁদের বড় মেয়ে। তাঁর আরও এক বোন ও পাঁচ ভাই ছিল।
গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ের মতোই সারদা ঘরের সব কাজ করতেন। তিনি ভাইবোনদের দেখাশোনা করতেন, গরুর জন্য ঘাস কাটতেন। ধানক্ষেতে মজুরদের জন্য মুড়ি নিয়ে যেতেন। স্কুলে পড়ার সুযোগ পাননি, তবে ভাইদের সঙ্গে মাঝে মাঝে পাঠশালায় যেতেন এবং সামান্য পড়াশোনা শিখতেন।
সারদা খুবই ধর্মপ্রাণ ছিলেন। ছোটবেলায় পুতুল খেলতে খেলতে মাটি দিয়ে লক্ষ্মী-কালীর মূর্তি বানিয়ে পূজো করতেন। গ্রামের যাত্রা বা কথকতার মাধ্যমে পুরাণের গল্প শুনে মুখস্থ করে ফেলতেন। তাঁর এই ধর্মীয় ভাব ভবিষ্যতে তাঁকে গভীর আধ্যাত্মিক জীবন গড়তে সাহায্য করেছিল।
বিবাহ ও প্রথম দেখা:
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে সারদার বিয়ে হয় শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে। তখন শ্রীরামকৃষ্ণের বয়স ছিল ২৩ বছর। বিয়ের পরও সারদা তাঁর বাপের বাড়িতে থাকতেন। চোদ্দ বছর বয়সে তিনি প্রথমবার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যান কামারপুকুরে। সেখানে তিনি তিন মাস ছিলেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে ধ্যান ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে শিক্ষা নেন।
দক্ষিনেশ্বর যাত্রা:
আঠারো বছর বয়সে সারদা শুনতে পেলেন যে তাঁর স্বামী নাকি পাগল হয়ে গেছেন। আবার কেউ বলল, তিনি একজন মহান সাধু। এই খবর শোনার পর, নিজের চোখে সত্যি দেখতে সারদা দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেও, শেষ পর্যন্ত ১৮৭২ সালের মার্চ মাসে দক্ষিণেশ্বর পৌঁছান।
দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে সারদা দেখলেন যে শ্রীরামকৃষ্ণ মোটেও পাগল নন, বরং তিনি একজন মহান ধর্মগুরু। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের নহবতের একতলায় একটি ছোট ঘরে সারদা থাকতে শুরু করলেন। তাঁর জীবন খুবই সাদাসিধে ছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ সারদাকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সারদা দেবী মা কালীর মতো একজন দেবী। একবার তিনি সারদাকে দেবীর আসনে বসিয়ে পূজোও করেছিলেন। এমনকি তিনি সারদাকে কখনোই কোনো কটু কথা বলেননি এবং সর্বদা তাঁকে “তুমি” বলে সম্বোধন করতেন।
আরও পড়ুন: শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জীবনী: এক আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক
শ্রীরামকৃষ্ণের শেষ দিন এবং সারদার সেবা:
শ্রীরামকৃষ্ণ যখন গলার ক্যানসারে ভুগছিলেন, তখন সারদা দিনরাত তাঁর সেবা করতেন। শুধু তাঁর সেবা করাই নয়, শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যদের জন্যও রান্না করতেন এবং তাঁদের যত্ন নিতেন। এই সময় তাঁর ধৈর্য এবং স্নেহ অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিল। ১৮৮৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর সারদা ভীষণ শোকাহত হন, তবে শিষ্যদের আধ্যাত্মিক জীবনে সাহায্য করার জন্য নিজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তীর্থযাত্রা:
শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর, সারদা দেবী উত্তর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান ঘুরে দেখেন। এর মধ্যে অযোধ্যা, কাশী এবং বৃন্দাবন উল্লেখযোগ্য। বৃন্দাবনে থাকার সময় তিনি গভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতি লাভ করেন। এই সময় থেকেই তিনি শিষ্যদের দীক্ষা দিতে শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে একজন আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
কলকাতার জীবন:
তীর্থ ভ্রমণের পর সারদা কিছুদিন কামারপুকুরে থাকেন। তবে সেখানে তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছিল। এই খবর পেয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যরা তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। সেখানে বাগবাজারে তাঁর জন্য একটি বাড়ি তৈরি হয়, যা “মায়ের বাড়ি” নামে পরিচিত। প্রচুর ভক্ত প্রতিদিন তাঁকে দেখতে আসতেন।
সারদা দেবীর নিজের কোনো সন্তান না থাকলেও সব ভক্তকে নিজের ছেলেমেয়ের মতো দেখতেন। সবাই তাকে ‘মা’ বলে ডাকত। শুধু ডাকাই নয়, সত্যিই তিনি সবার মায়ের মতো ছিলেন। যে যখন এসেছে, তার দুঃখ শুনেছেন, সান্ত্বনা দিয়েছেন, উপদেশ দিয়েছেন।
১৯০৬ সালে সারদার মা মারা যাওয়ার পর উনি পরিবারের দায়িত্ব নিলেন। ভাইয়ের বউ সুরবালার মেয়ে রাধুকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করলেন। রাধু ছিল একটু একগুঁয়ে স্বভাবের। কিন্তু সারদা খুব ধৈর্য ধরে তার দেখাশোনা করতেন।
শেষ জীবন ও মৃত্যু:
১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে সারদা দেবী জয়রামবাটীতে যান। এক বছর পর তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে কলকাতায় আনা হয়, কিন্তু ১৯২০ সালের ২০ জুলাই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর অন্ত্যেষ্টি বেলুড় মঠে গঙ্গার তীরে করা হয়।
মৃত্যুর আগে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছিলেন: “মা, যদি শান্তি চাও, কারও দোষ দেখো না। নিজের দোষ দেখো। সবাইকে আপন করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার।”
সারদা দেবীর জীবনের শিক্ষা ও মূল্যবোধ:
সারদা দেবীর জীবন ছিল এক জীবন্ত শিক্ষালয়। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের জন্য মূল্যবাণ শিক্ষা নিয়ে আসে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে এবং পরোপকারী। সহজ জীবনযাপন ও সংযম তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি নিজে গরিব কৃষক পরিবারের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও কখনো অভাবের জন্য অভিযোগ করেননি। বরং নিজের অসাধারণ ধৈর্য ও মানসিক শক্তির মাধ্যমে সমস্ত কষ্ট সহ্য করে গিয়েছেন। সারদা দেবী দেখিয়েছেন, সাফল্যের জন্য ধনসম্পত্তি নয়, বরং মানুষের প্রতি ভালোবাসা, ত্যাগ এবং সহিষ্ণুতার প্রয়োজন।
তাঁর সবচেয়ে বড় শিক্ষা ছিল সহিষ্ণুতা ও ধৈর্য। জীবনের যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্য হারানোর বদলে তিনি শান্তভাবে সেই সমস্যার মোকাবিলা করতেন। তাঁর শিষ্যদের কাছে তিনি বারবার বলতেন, “মা, যদি শান্তি চাও, তবে কারও দোষ দেখো না। নিজের দোষ দেখো।” অর্থাৎ, মানুষকে ভুল না ধরে বরং নিজের ভুল শুধরানোর চেষ্টা করা উচিত। এই উপদেশ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সারদা দেবীর আরেকটি বড় শিক্ষা ছিল সবার প্রতি ভালোবাসা। তিনি কোনো ভেদাভেদ করতেন না। নিজের সন্তান না থাকলেও, প্রতিটি ভক্তকে তিনি নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। তিনি বলতেন, “কেউ পর নয়। জগৎ তোমার।” এই কথার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, গোটা পৃথিবীকে নিজের পরিবারের মতো দেখতে হবে। তাঁর এই ভালোবাসার মধ্যেই মায়ের মতো স্নেহ এবং মাতৃত্বের পূর্ণতা প্রকাশ পেয়েছে।
সারদা দেবী আমাদের শিখিয়েছেন সহজভাবে জীবন কাটানো। তিনি দেখিয়েছেন যে জীবনের প্রকৃত সুখ ধনসম্পত্তি বা আরাম আয়েশে নয়, বরং মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সেবা, এবং আত্মত্যাগের মধ্যে লুকিয়ে আছে। তাঁর জীবন ছিল কর্ম ও আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ। তিনি নিজে ভক্তদের জন্য প্রতিদিন খাবার রান্না করতেন, অসুস্থ স্বামী শ্রীরামকৃষ্ণের সেবা করতেন এবং শিষ্যদের আধ্যাত্মিক দীক্ষা দিতেন।
তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ছিল পরোপকার ও সেবা। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। ভক্তদের দুঃখ-কষ্ট শুনতেন, সান্ত্বনা দিতেন, এবং সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করতেন।
শেষ কথা:
সারদা দেবী একজন সাধারণ মেয়ে থেকে কীভাবে সবার মা হয়ে উঠলেন, তা আমাদের শেখায় যে ভালোবাসা, সহমর্মিতা, আর ধৈর্যের মাধ্যমে মানুষ কতটা মহান হতে পারে। তাঁর জীবন আজও আমাদের সবার জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি সত্যিই “শ্রী শ্রী মা সারদা“।
সারদা দেবীর শিক্ষা ও মূল্যবোধ শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রে নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও এক অনন্য দিশা দেখায়। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে দয়া, ভালোবাসা, এবং সহিষ্ণুতার মাধ্যমে আমরা নিজেদের এবং অন্যদের জীবন সুন্দর করে তুলতে পারি। তাঁর জীবন থেকে পাওয়া এই শিক্ষাগুলি আজও মানুষের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে।
Source: Wikipedia