রামকৃষ্ণ পরমহংস ছিলেন এক মহান আধ্যাত্মিক গুরু, যার জীবন ও শিক্ষা শুধুমাত্র বাংলায় নয়, সারা বিশ্বের মানুষের মনকে আলোড়িত করেছে। তিনি ধর্ম, ভক্তি, এবং মানবতাকে একত্রিত করার এক মূর্ত প্রতীক। তার সরল জীবন, গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা, এবং “যত মত, তত পথ” দর্শনের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছিলেন, সব ধর্মই এক পথেরই ভিন্ন প্রকাশ।
রামকৃষ্ণের শিক্ষা শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি শিখিয়েছেন, মানবসেবাই হলো প্রকৃত ধর্ম। তার মতে, ঈশ্বর কেবল মন্দির, মসজিদ বা গির্জার মধ্যে সীমাবদ্ধ নন; বরং প্রতিটি জীবের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিদ্যমান।
সূচীপত্র:
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জীবনী:
বিষয় | তথ্য |
---|---|
আসল নাম | গদাধর চট্টোপাধ্যায় |
জন্ম | ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৬ |
জন্মস্থান | কামারপুকুর, হুগলি |
পিতা | ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় |
মাতা | চন্দ্রমণি দেবী |
স্ত্রী | সারদা দেবী |
গুরু | তোতাপুরী (বেদান্ত), ভৈরবী ব্রাহ্মণী (তন্ত্র) |
প্রধান শিষ্য | স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ |
উপদেশ | “যত মত, তত পথ”, “শিবজ্ঞানে জীবসেবা” |
মৃত্যু | ১৬ আগস্ট, ১৮৮৬ |
মৃত্যুর কারণ | ক্যান্সার |
মৃত্যুস্থান | কাশীপুর উদ্যানবাটি |
শৈশব ও পরিবার:
রামকৃষ্ণ পরমহংসের আসল নাম ছিল গদাধর চট্টোপাধ্যায়। তিনি ১৮৩৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়, এবং মাতা চন্দ্রমণি দেবী।
তাদের পরিবার ছিল অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। কথিত আছে, গদাধরের জন্মের আগে তার মা স্বপ্নে শিবলিঙ্গ থেকে একটি আলো তার গর্ভে প্রবেশ করতে দেখেছিলেন। আর পিতা স্বপ্নে বিষ্ণুর দর্শন পেয়েছিলেন। এ কারণেই তারা ছেলের নাম রাখেন গদাধর।
ছোটবেলায় গদাধর ছিলেন খুব প্রাণবন্ত এবং গ্রামের মানুষের প্রিয়। তিনি ছোট ছোট গল্প বলতেন, মাটির পুতুল বানাতেন, গান গাইতেন, আর যাত্রা অভিনয় করতেন। তবে স্কুলের পড়াশোনায় তার একেবারেই মন বসত না। তিনি বলতেন, “বই-পড়া বিদ্যা শুধু পুরোহিত হওয়ার জন্য। ঈশ্বরের কথা জানতে হলে জীবনের দিকে তাকাতে হয়।”
একবার ধানক্ষেতে হাঁটার সময় সাদা বক দেখে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে অজ্ঞান হয়ে যান। এমন ধরনের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা তার শৈশব থেকেই ছিল।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে যাত্রা এবং আধ্যাত্মিক অনুভূতি:
১৮৫৫ সালে কলকাতার রাণী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। রামকৃষ্ণের বড় ভাই রামকুমার সেখানে প্রধান পুরোহিত হন। পরে রামকৃষ্ণও সেখানে কাজ শুরু করেন।
তিনি প্রতিদিন দেবী কালীর পূজা করতেন। ধীরে ধীরে তিনি কালীকে নিজের মা এবং সারা জগতের জননী হিসেবে অনুভব করতে শুরু করেন। তিনি ভাবতেন, মূর্তি নয়, কালী মা সারা প্রকৃতিতে বিরাজমান।
একদিন কালী মায়ের দর্শন না পেয়ে তিনি এতই দুঃখ পেলেন যে নিজের জীবন শেষ করতে চাইলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি অনুভব করেন, কালী মা তাকে সামনে দাঁড়িয়ে আশীর্বাদ করছেন।
বিবাহ এবং সংসার জীবন:
রামকৃষ্ণ পরমহংস যখন দক্ষিণেশ্বরে ছিলেন, তখন তার পরিবারে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি পাগল হয়ে গেছেন। তার মা এবং ভাই তাকে বিবাহ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন, যাতে তিনি সংসারের দায়িত্বে মনোযোগ দেন। রামকৃষ্ণ নিজেই বলে দেন, তিনি যে মেয়েকে বিয়ে করবেন, সে কামারপুকুরের পাশের জয়েরামবাটির রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে।
১৮৫৯ সালে, মাত্র পাঁচ বছর বয়সী সারদা দেবীর সাথে তার বিয়ে হয়। যদিও সারদা দেবীর বয়স তখন খুব কম, তবে পরবর্তীতে তিনি রামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক জীবনযাত্রায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তাদের দাম্পত্যজীবন ছিল ভিন্ন ধরনের; রামকৃষ্ণ সারদা দেবীকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করতেন।
যখন সারদা দেবী বড় হয়ে দক্ষিণেশ্বরে এলেন, তাদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত পবিত্র। রামকৃষ্ণ তাকে মায়ের মতো দেখতেন এবং ‘মা’ বলে ডাকতেন। তাদের এই সম্পর্ক ছিল এক অনন্য উদাহরণ।
আরও পড়ুন: শ্রী শ্রী মা সারদা দেবীর জীবনী: এক আধ্যাত্মিক মায়ের গল্প
রামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক সাধনা:
তন্ত্রসাধনা:
রামকৃষ্ণ প্রথমে তন্ত্র সাধনা করেন। তার গুরু ছিলেন ভৈরবী ব্রাহ্মণী। তন্ত্র সাধনার নিয়ম অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু রামকৃষ্ণ এর মধ্যে কোনো অশুদ্ধ পথ গ্রহণ করেননি। তিনি সবসময় শুদ্ধতা বজায় রেখে সাধনা করতেন।
বৈষ্ণব ভক্তি:
বৈষ্ণব ভক্তিতে ঈশ্বরকে প্রেমের চোখে দেখা হয়। রামকৃষ্ণ কখনো হনুমানের মতো রামের সেবক, কখনো রাধার মতো কৃষ্ণের প্রেমিকা হয়ে ঈশ্বরকে অনুভব করেছেন।
বেদান্ত শিক্ষা:
একদিন এক সন্ন্যাসী তোতাপুরী এলেন। তার কাছে রামকৃষ্ণ অদ্বৈত বেদান্ত শিখলেন। এই শিক্ষা তাকে শিখিয়েছিল যে, ঈশ্বর সবকিছুতে আছেন এবং সবকিছুই ঈশ্বর।
সব ধর্মের সমন্বয়:
রামকৃষ্ণ বিশ্বাস করতেন, সব ধর্ম একই জায়গায় নিয়ে যায়। তিনি ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের নিয়মও পালন করেন। একদিন তিনি যিশুর দর্শন পান এবং বলেন, “সব ধর্মের মূল একটাই – প্রেম।”
শিক্ষা এবং দর্শন:
তিনি সবসময় সহজ উদাহরণ দিয়ে কঠিন জিনিস বোঝাতেন। একবার একজন জিজ্ঞেস করল, “ঈশ্বর কেমন?” তিনি বললেন, “যেমন মধু। তুমি কি মধু খেয়েছ? মধু কেমন মিষ্টি, তাই না? ঈশ্বরও তেমনি। তাকে পেলে মন মিষ্টি হয়ে যায়।”
তার আরেকটা বিখ্যাত শিক্ষা ছিল “যেখানে প্রেম, সেখানেই ঈশ্বর।” তিনি বলতেন, মানুষকে ভালোবাসলে ঈশ্বরকেও ভালোবাসা হয়। কারণ প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর আছেন।
রামকৃষ্ণ পরমহংস খুব সরল জীবন যাপন করতেন। তিনি কখনো দামি জামা-কাপড় পরতেন না। যা পেতেন, তাই খেতেন। টাকা-পয়সার দিকে তার কোনো আকর্ষণ ছিল না। তিনি বলতেন, “টাকা মাটি, মাটি টাকা।” মানে টাকা আর মাটি দুটোই একই রকম।
তার কাছে অনেক ধনী লোক আসত। কিন্তু তিনি কাউকে টাকা-পয়সার জন্য বেশি মর্যাদা দিতেন না। একবার একজন ধনী ব্যবসায়ী এসে বললেন, “ঠাকুর, আমি অনেক টাকা দান করব।” রামকৃষ্ণ পরমহংস বললেন, “টাকা দিয়ে কি ঈশ্বরকে কেনা যায়? ঈশ্বরকে পেতে হলে ভালোবাসা চাই।”
রামকৃষ্ণ পরমহংস শুধু কথা বলতেন না, তিনি যা বলতেন তা নিজের জীবনে পালন করতেন। তিনি কখনো কারও সঙ্গে ঝগড়া করতেন না। কেউ তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেও তিনি হাসি মুখে সহ্য করতেন।
রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিক্ষা ছিল সহজ ও সবার জন্য গ্রহণযোগ্য। তার গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ:
- যত মত, তত পথ
→ সব ধর্মই সঠিক এবং একই ঈশ্বরের পথে নিয়ে যায়। - শিবজ্ঞানে জীবসেবা
→ মানুষের সেবা করো, যেন ঈশ্বরকেই সেবা করছ। - কাম-কাঞ্চন ত্যাগ
→ লোভ আর কামনা মানুষকে ঈশ্বর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তাই এগুলো থেকে মুক্ত হও। - সরলতা
→ ধর্ম মানে সরল জীবনযাপন, ভালোবাসা আর দয়া। - ঈশ্বর অর্জনই জীবনের লক্ষ্য
→ রামকৃষ্ণের মতে, ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়াই মানুষের জীবনের প্রধান লক্ষ্য।
প্রভাব এবং শিষ্য:
রামকৃষ্ণ পরমহংসের জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি যে ধর্ম মানে কোনো জটিল দর্শন নয়। ধর্ম মানে হল সরল জীবন যাপন করা, সবাইকে ভালোবাসা, আর ঈশ্বরকে খোঁজা। তিনি দেখিয়ে গেছেন যে সত্যিকারের ধর্ম কখনো মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা করে না, বরং সবাইকে একসূত্রে বাঁধে।
রামকৃষ্ণ পরমহংসের অনেক শিষ্য ছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তার আসল নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তার আরও অনেক শিষ্য ছিল। কেউ কেউ সংসার করতেন, যেমন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। আর কেউ কেউ সন্ন্যাসী হয়েছিলেন, যেমন স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ।
তার স্ত্রী সারদা দেবীও একজন আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাকে মানুষ ‘শ্রী মা’ বলে ডাকত।
রামকৃষ্ণের শেষ দিন এবং মৃত্যু:
১৮৮৫ সালে, রামকৃষ্ণের গলায় ক্যানসার ধরা পড়ে। তখন তার শিষ্য এবং সারদা দেবী মিলে তার সেবা করেন। তিনি কাশীপুর উদ্যানবাটিতে শেষ জীবন কাটান। ১৮৮৬ সালের ১৬ আগস্ট তিনি প্রয়াত হন।
মৃত্যুর আগে তিনি স্বামী বিবেকানন্দকে ডেকে বললেন, “তোমাকে অনেক শক্তি দিলাম। এখন তুমি মানুষের সেবা করো।” এই কথা শুনে বিবেকানন্দ পরে সারা দুনিয়ায় হিন্দু ধর্মের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ এবং অন্যান্যরা মিলে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজও সারা বিশ্বে তার শিক্ষা প্রচার করছে।
রামকৃষ্ণের শেষ কথাগুলো ছিল খুব তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বললেন, “যতদিন আমি দেহে ছিলাম, ততদিন শিখিয়েছি। এখন যাচ্ছি। তোমরা নিজেরা নিজেদের পথ খুঁজে নাও। তবে মনে রেখো, সবার মধ্যে ঈশ্বর আছেন।”
শেষ কথা:
রামকৃষ্ণ পরমহংসের জীবন এবং শিক্ষা আমাদের শেখায় যে সত্যিকারের ধর্ম মানুষকে এক করে, বিভক্ত করে না। তার জীবন ছিল এক মহৎ উদাহরণ—কীভাবে একজন সাধারণ মানুষ অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে।
আজও তার শিক্ষা কোটি কোটি মানুষের জন্য প্রেরণার উৎস। “যত মত, তত পথ” – এই সরল কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানবতার মন্ত্র।
Source: Wikipedia