ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সমাজ সংস্কারের ইতিহাসে একজন অ্যাংলো-আইরিশ মহিলার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তিনি ভগিনী নিবেদিতা। আয়ারল্যান্ড থেকে এসে যিনি ভারতকে নিজের দেশ করে নিয়েছিলেন, ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নিজের করে নিয়েছিলেন।
সূচীপত্র:
ভগিনী নিবেদিতার জীবনী:
বিষয় | তথ্য |
---|---|
আসল নাম | মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল |
জন্ম | ২৮ অক্টোবর, ১৮৬৭ |
জন্মস্থান | ডানগ্যানন, উত্তর আয়ারল্যান্ড |
পিতা | স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবেল |
মাতা | মেরি ইসাবেলা |
মৃত্যু | ১৩ অক্টোবর, ১৯১১ |
শৈশব ও পরিবার:
ভগিনী নিবেদিতা (জন্মকালীন নাম: মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল) ১৮৬৭ সালের ২৮ অক্টোবর উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডানগ্যানন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবেল ছিলেন একজন পাদ্রী। মা মেরি ইসাবেলা ছিলেন একজন সাধারণ গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই মার্গারেট খুব মেধাবী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি বাবার কাছ থেকে শিখেছিলেন, “মানব সেবাই ঈশ্বর সেবা।” এই আদর্শ তার পরবর্তী জীবনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
কিন্তু মাত্র দশ বছর বয়সেই তার জীবনে নেমে আসে বড় দুঃখ। বাবা মারা যান। এরপর তার দাদু হ্যামিলটন তাকে মানুষ করেন। তিনি সঙ্গীত, শিল্প এবং শিক্ষা বিষয়ে গভীর আগ্রহী ছিলেন। দাদু নিজেও ছিলেন আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন নেতা। হয়তো তার কাছ থেকেই মার্গারেট স্বাধীনতার বীজমন্ত্র পেয়েছিলেন।
শিক্ষা জীবন:
মার্গারেট লন্ডনের চার্চ বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করেন। এরপর হ্যালিফ্যাক্স কলেজে পড়েন। তার বোন মেরিও একই কলেজে পড়তেন। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি শিক্ষার নতুন পদ্ধতি নিয়ে ভাবতেন। মনে করতেন শিক্ষা শুধু বই পড়া নয়, এর মাধ্যমে মানুষের চরিত্র গঠন হওয়া দরকার।
পর্ব | বিবরণ |
---|---|
প্রাথমিক শিক্ষা | লন্ডনের চার্চ বোর্ডিং স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। |
উচ্চ শিক্ষা | হ্যালিফ্যাক্স কলেজে পড়াশোনা করেন। |
বিশেষ দক্ষতা | সঙ্গীত ও শিল্পকলায় বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। |
মাত্র সতেরো বছর বয়সে শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। প্রথমে কেসউইকের একটি বেসরকারি স্কুলে পড়ান। এরপর রেক্সহ্যাম, চেস্টার আর লন্ডনের উইম্বলডনে শিক্ষকতা করেন। ১৮৯৫ সালে নিজেই একটা স্কুল খোলেন – ‘রাস্কিন স্কুল‘। এখানে তিনি নতুন ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি চালু করেন।
স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ:
১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাস। লন্ডনের এক বাড়িতে পারিবারিক অনুষ্ঠানে মার্গারেট স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা শোনেন। সেদিন স্বামী বিবেকানন্দ বেদান্ত দর্শন নিয়ে কথা বলছিলেন। তার কথা শুনে মার্গারেট মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এর আগে তিনি কখনও এমন করে ধর্ম ও দর্শনের কথা শোনেননি।
এরপর থেকে তিনি বিবেকানন্দের প্রতিটি বক্তৃতায় যেতে শুরু করলেন। শুধু তাই নয়, প্রশ্ন করতেন, আলোচনা করতেন। ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারলেন যে বিবেকানন্দের চিন্তাধারা তার নিজের চিন্তার সাথে মিলে যাচ্ছে। তিনি বিবেকানন্দকে গুরু হিসেবে বরণ করে নিলেন।
ভারতে আগমন:
১৮৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি। মার্গারেট সব কিছু ছেড়ে ভারতে চলে এলেন। নিজের দেশ, পরিবার, স্কুল – সব পিছনে ফেলে এলেন এক অজানা দেশে। কিন্তু তার মনে কোনো ভয় ছিল না। কারণ তার বিশ্বাস ছিল যে এই দেশে তার করার মতো অনেক কাজ আছে।
ভারতে এসে তিনি বিবেকানন্দের কাছে ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি, দর্শন সব শিখতে থাকেন। কিছুদিন পর তার সাক্ষাৎ হয় শ্রীরামকৃষ্ণের স্ত্রী সারদা মার সাথে। ২৫ মার্চ বিবেকানন্দ তাকে সন্ন্যাস দীক্ষা দেন। সেদিন থেকে মার্গারেট নোবেল হয়ে গেলেন ‘ভগিনী নিবেদিতা‘।
আরও পড়ুন: স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী: এক বীর সন্ন্যাসীর আদর্শ
শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান:
ভগিনী নিবেদিতা কলকাতার বাগবাজারে ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনে একটি মেয়েদের স্কুল খোলেন। বর্তমানে যা সিস্টার নিবেদিতা গার্লস স্কুল নাম পরিচিত। সেই সময় মেয়েদের লেখাপড়া শেখার সুযোগ খুব কম ছিল। অনেক পরিবার মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে চাইত না। নিবেদিতা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বোঝাতেন। তিনি শুধু ইংরেজি নয়, বাংলা, সংস্কৃত, ইতিহাস, ভূগোল সব পড়াতেন।
সমাজসেবা:
১৮৯৯ সালে কলকাতায় প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। ভগিনী নিবেদিতা তখন স্থানীয় যুবকদের নিয়ে রোগীদের সেবা করতে শুরু করেন। রাস্তাঘাট পরিষ্কার করেন। এই সময় তিনি নিজের সব সঞ্চয় মানুষের সেবায় খরচ করে ফেলেন।
নিবেদিতার পদক্ষেপ:
- স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করেন
- রোগীদের সেবা করেন
- রাস্তাঘাট পরিষ্কার করেন
- স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ান
- নিজের সমস্ত সঞ্চয় মানুষের সেবায় ব্যয় করেন
- বিদেশ থেকে আনা টাকা-পয়সা সবই খরচ করে ফেলেন
- নিজে অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন
স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ:
১৯০২ সালে স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যু হয়। এর পর ভগিনী নিবেদিতা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। রামকৃষ্ণ মিশনের নিয়ম অনুযায়ী সন্ন্যাসীরা রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারতেন না। তাই তিনি মিশনের সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছেড়ে দেন। তবে সারদা মা এবং অন্যান্য সন্ন্যাসীদের সাথে তার সম্পর্ক অটুট ছিল।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তিনি গোপনে বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন। অরবিন্দ ঘোষের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। শুধু রাজনীতি নয়, তিনি সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান সব ক্ষেত্রেই সক্রিয় ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মনীষীদের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল।
সাহিত্য সৃষ্টি:
ভগিনী নিবেদিতা অনেক বই লিখেছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, শিল্প – নানা বিষয়ে তার লেখা প্রকাশিত হত।
১. কালী দ্য মাদার (Kali the Mother)
- প্রকাশকাল: ১৯০০
- বিষয়বস্তু: মা কালীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য
- মূল আলোচ্য:
- কালী ঠাকুরের দার্শনিক ব্যাখ্যা
- শক্তি উপাসনার তাৎপর্য
- ভারতীয় নারী শক্তির প্রতীক হিসেবে কালী
২. ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ (The Web of Indian Life)
- প্রকাশকাল: ১৯০৪
- বিষয়বস্তু: ভারতীয় সমাজ জীবনের বিস্তৃত চিত্র
- মূল আলোচ্য:
- হিন্দু পরিবার ব্যবস্থা
- সামাজিক রীতিনীতি
- ভারতীয় নারীর জীবন
- সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনযাপন
৩. ক্রেডল টেলস অফ হিন্দুইজম (Cradle Tales of Hinduism)
- প্রকাশকাল: ১৯০৭
- বিষয়বস্তু: হিন্দু পুরাণের গল্প
- মূল আলোচ্য:
- রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী
- পুরাণের নৈতিক শিক্ষা
- ভারতীয় সংস্কৃতির মূল্যবোধ
- ধর্মীয় আদর্শের ব্যাখ্যা
৪. দ্য মাস্টার অ্যাজ আই শ হিম (The Master as I Saw Him)
- প্রকাশকাল: ১৯১০
- বিষয়বস্তু: স্বামী বিবেকানন্দের জীবন ও শিক্ষা
- মূল আলোচ্য:
- গুরুর সাথে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
- বিবেকানন্দের চিন্তাধারা
- তার শিক্ষার মূল বক্তব্য
- বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যা
পত্রিকাসমূহ যেখানে লিখতেন:
- মডার্ন রিভিউ
- দ্য স্টেটসম্যান
- অমৃতবাজার পত্রিকা
- ডন
- প্রবুদ্ধ ভারত
- বালভারতী
শেষ জীবন:
ভগিনী নিবেদিতা ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর দার্জিলিঙে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স তখন মাত্র ৪৪ বছর। অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং ভারতীয় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার জন্য তিনি শারীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি জগদীশচন্দ্র বসু এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে ছিলেন।
অবদান ও স্মৃতি:
ভগিনী নিবেদিতার প্রভাব ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে রয়ে গেছে। তার লেখা ‘কালী দ্য মাদার’ বই পড়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিখ্যাত ‘ভারতমাতা‘ চিত্রটি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাকে ‘লোকমাতা‘ বলে সম্বোধন করতেন।
আজও তার নামে অনেক স্কুল-কলেজ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ভবন তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। চেন্নাইতে রয়েছে সিস্টার নিবেদিতা অ্যাকাডেমি। ১৯৬৮ সালে ভারত সরকার তার স্মৃতিতে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
শেষ কথা:
ভগিনী নিবেদিতার জীবন শুধুমাত্র ভারতীয় সমাজের প্রতি গভীর প্রেম এবং মানবসেবার প্রতীক নয়, বরং এটি এক বিরল আত্মত্যাগের গল্প। তিনি ভারতীয় সমাজকে একটি নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন এবং প্রমাণ করেছিলেন যে আত্মত্যাগ এবং মানবসেবা জাতি বা বর্ণের সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে।
একজন বিদেশিনী হয়ে নিবেদিতা যেভাবে ভারতকে ভালোবেসে ছিলেন, ভারতের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তা অতুলনীয়। তিনি শুধু শিক্ষিকা ছিলেন না, ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, লেখিকা। তার জীবন আজও আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়।