নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে থাকা এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক গভীর দাগ রেখে গেছে। ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ওড়িশার কটকে এক বিখ্যাত পরিবারে তার জন্ম হয়। তিনি তার জীবনের সমস্ত কিছু দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তার অসীম সাহস, দেশপ্রেম, এবং নেতৃত্বগুণ তাকে ভারতের ইতিহাসে অমর করে তুলেছে।
সূচীপত্র:
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনী:
বিষয় | তথ্য |
---|---|
নাম | সুভাষচন্দ্র বসু |
জন্ম | ২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭ |
জন্মস্থান | কটক, ওড়িশা (তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত) |
পিতা | জানকীনাথ বসু (আইনজীবী) |
মাতা | প্রভাবতী বসু |
মৃত্যু | ১৮ আগস্ট ১৯৪৫ |
মৃত্যুস্থান | তাইওয়ান (বিমান দুর্ঘটনা, তবে বিতর্কিত) |
প্রথম জীবন ও শিক্ষা:
সুভাষচন্দ্র বসুর পরিবার ছিল শিক্ষিত এবং ঐতিহ্যবাহী। তার বাবা জানকীনাথ বসু ছিলেন একজন সফল আইনজীবী, আর মা প্রভাবতী বসু ছিলেন ধর্মপ্রাণ এবং স্নেহশীল। ছোটবেলা থেকেই সুভাষ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তার মধ্যে মানুষের প্রতি দয়া এবং সেবা করার মানসিকতা ছিল, যা তিনি তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন।
ছোটবেলায় সুভাষ খুবই মেধাবী এবং চঞ্চল ছিলেন। কটকের প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপীয় স্কুলে (বর্তমান স্টুয়ার্ট স্কুল) তার প্রাথমিক পড়াশোনা হয়। পরে তিনি কটকের রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। তার বাড়িতে বাংলা ভাষার চল থাকলেও স্কুলে ইংরেজি পড়া বাধ্যতামূলক ছিল। এর ফলে ছোটবেলা থেকেই তিনি দুই ভাষাতেই দক্ষ হয়ে ওঠেন। এরপর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখানেই তার মধ্যে দেশপ্রেমের বীজ অঙ্কুরিত হয়।
১৯১২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। এরপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং পাশ্চাত্য দার্শনিকদের চিন্তাধারা তাঁকে আকৃষ্ট করে। ক্যান্ট, হেগেল, ও স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শ তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। যদিও তাঁর শিক্ষাজীবন একাধিকবার ব্যাহত হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করার সময় ইংরেজ অধ্যাপকের জাতিবিদ্বেষী আচরণের প্রতিবাদ করেন এবং এর ফলে তাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বিষয় | তথ্য |
---|---|
প্রাথমিক শিক্ষা | প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুল, কটক |
উচ্চ শিক্ষা | প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা |
অধ্যয়নের বিষয় | দর্শন (ফিলোসফি) |
প্রভাবিত আদর্শ | স্বামী বিবেকানন্দ এবং পাশ্চাত্য দর্শন |
দেশপ্রেমের উত্থান:
সুভাষচন্দ্র ইংল্যান্ডে যান এবং ১৯২০ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস (ICS) পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন। কিন্তু ব্রিটিশদের হয়ে কাজ করা তাঁর কাছে অপমানজনক মনে হয়। তিনি চাকরিতে যোগ না দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। দেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশদের শোষণের প্রতি তীব্র বিরোধিতা করতেন।
“কোনো শাসন ব্যবস্থাকে শেষ করার সেরা উপায় হলো সেই শাসন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া।”
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু
ভারতে ফিরে তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু। দেশবন্ধুর আদর্শ এবং নেতৃত্ব সুভাষকে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। তিনি কলকাতা পৌরসংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবেও কাজ করেন। পরে তিনি ‘ফরোয়ার্ড’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রচারে মনোনিবেশ করেন।
কংগ্রেসে নেতৃত্ব ও মতবিরোধ:
সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯ সালে পরপর দু’বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। তবে তার মতাদর্শ ছিল গান্ধীজির অহিংস নীতির চেয়ে আলাদা। তিনি বিশ্বাস করতেন, শুধুমাত্র অহিংস আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা এনে দিতে পারবে না। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশদের ভারত থেকে তাড়ানো সম্ভব বলে তিনি দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলেন।
তার নেতৃত্বে কংগ্রেস দলে একটি শক্তিশালী যুব আন্দোলন গড়ে ওঠে। তিনি শিল্পায়ন, বিজ্ঞান, এবং প্রযুক্তির উপর জোর দেন এবং ভারতকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা করেন। তবে, মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত পার্থক্যের কারণে ১৯৩৯ সালে তিনি কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
পদত্যাগের পর তিনি “ফরওয়ার্ড ব্লক” নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। এই দলটি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করত।
আজাদ হিন্দ ফৌজের যাত্রা:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সুভাষচন্দ্র বসু বুঝতে পেরেছিলেন যে, ব্রিটিশদের দুর্বল অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতার সুযোগ তৈরি করা সম্ভব। তাই তিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা শুরু করেন।
১৯৪১ সালে সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ নজরদারি এড়িয়ে আফগানিস্তান ও রাশিয়া হয়ে জার্মানি যান। সেখানে তিনি হিটলারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার কাছ থেকে সাহায্য চান। পরে, তিনি জাপান যান এবং জাপানের সহায়তায় “আজাদ হিন্দ ফৌজ” পুনর্গঠন করেন। এই ফৌজে ভারতীয় যুদ্ধবন্দি এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রবাসী ভারতীয়রা যোগ দিয়েছিলেন।
“তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো,”
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু
সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ইম্ফল এবং ব্রহ্মদেশে (বার্মা) যুদ্ধ করে। তার নেতৃত্বে গঠিত নারী বাহিনী, “ঝাঁসির রানি রেজিমেন্ট“, ছিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী সেনাদল।
বিষয় | তথ্য |
---|---|
রাজনৈতিক গুরু | চিত্তরঞ্জন দাশ |
প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন | অসহযোগ আন্দোলন |
কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে মেয়াদ | ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯ |
গঠিত সংগঠন/দল | ফরওয়ার্ড ব্লক, আজাদ হিন্দ ফৌজ |
নারী ইউনিটের নাম | ঝাঁসির রানি রেজিমেন্ট |
আরও পড়ুন: মহাত্মা গান্ধীর জীবনী: এক মহাত্মার জীবন দর্শন
অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা:
নেতাজী ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে “আর্জি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ” নামে ভারতের অস্থায়ী স্বাধীন সরকার গঠন করেন। এই সরকারের বৈশিষ্ট্য ছিল:
- নিজস্ব মুদ্রা, ডাকটিকিট এবং আইনি ব্যবস্থা।
- অক্ষশক্তির দেশগুলো যেমন জার্মানি, জাপান, ইতালি, চীন, ফিলিপাইন ইত্যাদি সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।
এই সরকার মূলত জাপানের অধিকৃত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং তাদের নামকরণ করে “শহীদ” ও “স্বরাজ”।
দিল্লি চলো – অভিযান:
নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত দিয়ে ব্রিটিশ রাজ্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করে। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করা।
- ইম্ফল ও কোহিমা যুদ্ধ: ১৯৪৪ সালে জাপানি বাহিনীর সহযোগিতায় আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের ইম্ফল এবং কোহিমা দখলের জন্য আক্রমণ চালায়। যদিও প্রথমদিকে তাঁরা কিছু সফলতা অর্জন করেছিল, কিন্তু ব্রিটিশ এবং মিত্র বাহিনীর শক্তিশালী প্রতিরোধ এবং জাপানি সেনাবাহিনীর দুর্বলতায় এই অভিযান ব্যর্থ হয়।
- যুদ্ধক্ষেত্রে চরম সংকট: যুদ্ধে জাপান এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যরা খাবার, অস্ত্র এবং সরঞ্জামের অভাবে ভুগছিল। মিত্র বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে তাঁদের পশ্চাদপসরণ করতে হয়। এই ব্যর্থতা নেতাজী এবং তাঁর ফৌজের মনোবলে বড় ধাক্কা দেয়।
জাপানে শেষ মুহূর্তের দিনগুলো:
১৯৪৫ সালের শুরুতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অক্ষশক্তি (Axis Powers) দুর্বল হতে শুরু করে। জাপান মিত্রশক্তির (Allied Powers) কাছে ক্রমাগত পরাজিত হতে থাকে। এই অবস্থায় জাপানের উপর থেকে নেতাজীর আন্দোলনের জন্য আর্থিক এবং সামরিক সহায়তা কমতে থাকে।
- রেঙ্গুন থেকে সরে আসা: ব্রিটিশ বাহিনী যখন বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) পুনর্দখল করে, তখন নেতাজী তাঁর আজাদ হিন্দ সরকারের সদর দপ্তর রেঙ্গুন থেকে সিঙ্গাপুরে স্থানান্তর করেন।
- জাপানের আত্মসমর্পণ: ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে, জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। এই ঘটনাটি নেতাজীর স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল। তিনি বুঝতে পারলেন যে জাপান তাঁর আন্দোলনের আর কোনও সহায়তা করতে পারবে না।
মৃত্যু এবং রহস্য:
জাপান আত্মসমর্পণ করার পর, নেতাজী সিদ্ধান্ত নেন সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার, কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে সোভিয়েতরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তাঁকে সমর্থন করতে পারে। ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট সুভাষচন্দ্র বসু তাইপেইতে একটি জাপানি সামরিক বিমানে চড়ে মাঞ্চুরিয়া যাচ্ছিলেন। তবে, বিমানের একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায় এবং বিমানটি দুর্ঘটনার শিকার হয়। সেই বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয় বলে জানানো হয়। তবে তার মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক আজও রহস্যময় হয়ে রয়েছে। অনেকেই মনে করেন তিনি দুর্ঘটনায় মারা যাননি এবং আরও অনেক বছর বেঁচে ছিলেন।
সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শ:
সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা। তার নেতৃত্বগুণ এবং চিন্তাভাবনা ভারতকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। তিনি মনে করতেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন জরুরি। তিনি ভারতে শিল্প এবং বিজ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ গঠনের পক্ষে ছিলেন।
তার স্বাধীনতা সংগ্রাম, সাহস এবং নেতৃত্ব ভারতের জনগণকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস জুগিয়েছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যদের আত্মত্যাগ এবং সুভাষচন্দ্রের নীতির প্রভাব ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে গভীরভাবে শক্তিশালী করেছিল।
বিখ্যাত উক্তি ও শ্রদ্ধাঞ্জলি:
সুভাষচন্দ্র বসুর কিছু বিখ্যাত উক্তি আজও মানুষের মনোভাবকে জাগ্রত করে:
- “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।”
- “জয় হিন্দ” – যা আজ ভারতের জাতীয় অভিবাদন।
- “দিল্লি চলো” – যা ছিল তার সেনাদলের জন্য অনুপ্রেরণা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে “দেশনায়ক” উপাধি দিয়েছিলেন এবং তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে “তাসের দেশ” নাটকটি উৎসর্গ করেছিলেন। তার নামে কলকাতায় “নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর” এবং বহু রাস্তা, স্টেডিয়াম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার জন্মদিন পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়।
শেষ কথা:
সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মূর্ত প্রতীক। তার সংগ্রাম, ত্যাগ, এবং নেতৃত্ব আমাদের জাতীয় জীবনের অমূল্য সম্পদ। তার জীবন আমাদের শিখিয়ে যায়, স্বপ্ন সফল করতে হলে সাহস এবং দৃঢ়তার প্রয়োজন। তিনি যে পথে হেঁটেছিলেন, সেই পথ আজও আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সুভাষচন্দ্র বসুর ভূমিকা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার জীবন ও আদর্শ প্রতিটি ভারতীয়কে দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগের মহান শিক্ষা দেয়।
Source: Wikipedia